আইএমএফের চাপে ডলারের বাজার উন্মুক্ত
আপলোড সময় :
১৫-০৫-২০২৫ ১০:৫৯:৫২ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় :
১৫-০৫-২০২৫ ১০:৫৯:৫২ পূর্বাহ্ন
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় নিয়ে পানি ঘোলা কম হয়নি গত কয়েক মাসে। আইএমএফের সঙ্গে শর্ত পালন নিয়ে রীতিমতো দর-কষাকষি চলেছে। অবশেষে নমনীয় হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ঘোষণা দিল ডলারের বাজার উন্মুক্ত করার। অর্থাৎ ডলারের রেট বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলো। মার্কিন ডলারের দাম এখন থেকে বাজার ঠিক করবে বলে বুধবার জানিয়ে দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দুবাই থেকে অনলাইনে যোগ দিয়ে তিনি বলেন, আশা করছি দাম এখনকার দামের আশপাশে থাকবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের ফলে বাজারে মার্কিন ডলারের দাম চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে; যা আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসারে বাজারভিত্তিক হিসাবে পরিচিত। তবে বাংলাদেশ ডলারের দর বাজারভিত্তিক মানে কিন্তু যেমন খুশি তেমন দরে লেনদেন করা যাবে না। মূলত ব্যাংক এবং মানি চেঞ্জার্সগুলো সকাল-বিকাল দাম ঘোষণা দিয়ে লেনদেন করবে। আর সেই দর এবং লেনদেনের পরিমাণ অবশ্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানাতে হবে। নতুন বাজারভিত্তিক দর বুধবার থেকেই কার্যকর করা হয়েছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমার মতে ডলারের রেট বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি দরকার ছিল সেটি নিয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমি মনে করি এখনই সঠিক সময়। কারণ এখন রেমিট্যান্সের ফ্লো ভালো, আমদানি বাণিজ্য ভালো, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে, বিশ্ববাজারে ডলারের দাম কমছে। এ ছাড়া রিজার্ভও ক্রমেই ভালোর দিকে যাচ্ছে। তার চেয়ে বড় কথা রিজার্ভ স্থিতিশীল পর্যায়ে আছে। সুতরাং এর চেয়ে ভালো সময় আর কী হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ডলারের রেট বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ায় বাজার অস্থির হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ বাজারে এখন ডলারের সংকট নেই। রিজার্ভ আগের চেয়ে ভালো, স্থিতিশীল রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিংও চালু আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিনই দুই বেলা ডলারের বাজার মনিটরিং করবে। এর মাধ্যমেও বাজার অস্থিতিশীল হওয়া ঠেকানো যাবে।
শেষ পর্যন্ত আইএমএফের চাপেই ডলারের বাজার উন্মুক্ত করা হলো, এমন কথা বলা হচ্ছে এ বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, ‘ঋণের কিস্তি নিয়ে গত কয়েক মাসে জল ঘোলা কম হয়নি। দেশে এবং দেশের বাইরে দফায় দফায় বৈঠকও কম হয়নি। তবুও বরফ গলছিল না। শেষ পর্যন্ত আইএমএফ বাধ্য হলো বাংলাদেশকে ঋণ দিতে। অনেকেই হয়তো বলছেন, আইএমএফের চাপেই বাংলাদেশ ব্যাংক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিন্তু আমি তো বলব উল্টোটা আইএমএফই বাংলাদেশের কাছে নতিস্বীকর করেছে। তারাই বাধ্য হয়েছে ঋণের কিস্তি ছাড় করতে। কেননা আইএমএফ বড় তিনটি শর্ত দিয়েছিল রাজস্ব বাড়ানো, ভর্তুকি কমানো এবং ডলারের রেট বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে।
বাংলাদেশের তরফ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে এ মুহূর্তে রাজস্ব আয় বাড়ানো ও ভর্তুকি কমাতে জ্বালানি বা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো যাবে না। এরপর আইএমএফ ডলারের শর্তে অনড় অবস্থান নেয়। এর অর্থ দাঁড়াল তাদের তিন শর্তের দুটি মানলেও ঠিকই তারা ঋণের কিস্তি ছাড়ে বাধ্য হলো।’
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দুবাই থেকে অনলাইনে যোগ দিয়ে ডলারের বাজার উন্মুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে গভর্নর বলেন, ‘আশা করছি, দাম এখনকার দামের আশপাশে থাকবে।’ খেয়াল খুশি মতো মার্কিন ডলার কেনাবেচা করা যাবে না। করার মানেই যেকোনো দরে কিনবে তেমন না। এখন যে দরে বেচাকেনা হচ্ছে তার আশপাশেই থাকবে।
এদিকে গতকাল বিকালেই ডলারের বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ দর ১২২ টাকার সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনের সংশ্লিষ্ট ধারা বাতিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখান বাজারভিত্তিক দর অবিলম্বে কার্যকর করার কথা জানানো হয়েছে। বুধবার সকালে ব্যাংকগুলোকে বাজারভিত্তিক দামে লেনদেন করতে বলা হয়েছিল। তবে এখনকার দামের সঙ্গে যেন খুব বেশি পার্থক্য না হয়, সেদিকে নজর রাখতে নির্দেশনা ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ডলারের বিনিময়হার বাজারভিত্তিক করার এখন ভালো সময়। তার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এখন প্রবাসী আয় ভালো আসছে, রিজার্ভও স্থিতিশীল, উন্নতি হয়েছে লেনদেন ভারসাম্যের। আর আগামী জুন মাসের মধ্যে ৩৫০ কোটি ডলার আসবে। এতে রিজার্ভ আরও বাড়বে। ফলে বিনিময়হার বাজারভিত্তিক করার এটাই ভালো সময়।’ আর জুন মাসে তো আইএমএফের ৪৭০ কোটি ঋণের ১৩০ কোটি ডলার ছাড় পাচ্ছে।
গভর্নর বলেন, বুধবার থেকেই বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময়হার চালুর সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে। যা আইএমএফের ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল। যা অনুসরণ করে বহুপাক্ষিক ঋণদাতারা। আগামী জুন নাগাদ আরও ৩৫০ কোটি ডলারের ঋণ পাবে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এসব ঋণ দেবে।
ড. মনসুর বলেন, ব্যাংকগুলোকে আজকের সভায় বাজারভিত্তিক বিনিময়হার সম্পর্কে জানানো হয়েছে। তবে বড় অঙ্কের বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিনিময়হার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজন হলে হস্তক্ষেপ করবে। যা বিশেষ বাজারভিত্তিক হিসাবে দেখাছেন গভর্নর। এ ছাড়া একটি ব্যান্ড এক্সচেঞ্জ রেট থাকবে যা প্রকাশ করা হবে না। তিনি বলেন, আইএমএফের সঙ্গে করা চুক্তিতে তারা আমাদের বলেছিল, এক্সচেঞ্জ রেট (বিনিময়হার) বাজারভিত্তিক করার জন্য। তবে সে সময় আমাদের বাজার প্রস্তুত না থাকায় আমরা সেটি বাস্তবায়ন করিনি। বর্তমানে বাজারে ডলারের তারল্য থাকার কারণে নতুন বিনিময়হার বিদ্যমান হারের কাছাকাছিই থাকবে বলেও আশা প্রকাশ করেন গভর্নর।
জুনে মিলবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি থেকে ৩৫০ কোটি ডলার : এদিকে সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর আরও জানান, বহুপক্ষীয় ঋণদাতাদের থেকে জুন নাগাদ আরও ৩৫০ কোটি ডলারের ঋণ পাবে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এসব ঋণ দেবে। বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
জুনের মধ্যেই আইএমএফ ঋণের ১৩০ কোটি ডলার ছাড় করবে। এর সঙ্গে আরও প্রায় ২০০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা আসবে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, এআইআইবি, জাপান এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে।
এদিকে গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আইএমএফের চতুর্থ পর্যালোচনা সফলভাবে শেষ হয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও বিনিময়হার ব্যবস্থায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বিষয়ে অধিকতর পর্যালোচনার লক্ষ্যে চতুর্থ মিশন সম্পন্ন হওয়ার পর নির্ধারিত কিস্তির অর্থ একত্রে ছাড় করা হবে, এমন সিদ্ধান্ত হয় তৃতীয় পর্যালোচনায়। সে ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ পর্যালোচনার সময় বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং পরবর্তীকালে একই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের সভায় আলোচনা চলমান থাকে।
অর্থ মন্ত্রণালয় আরও বলছে, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে সব বিষয় সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনা করে উভয় পক্ষ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, মুদ্রা বিনিময়হারসহ অন্যান্য সংস্কার কাঠামো বিষয়ে সম্মত হয়েছে। চতুর্থ পর্যালোচনার ‘স্টাফ লেভেল এগ্রিমেন্ট’ সম্পন্ন হওয়ায় আশা করা হচ্ছে আইএমএফ চলতি বছরের জুনের মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির জন্য নির্ধারিত ১৩০ কোটি ডলার একত্রে ছাড় করবে।
উল্লেখ্য, আইএমএফের ঋণের তিনটি কিস্তি বাবদ ২ দশশিক ৩১ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। বাকি দুটি কিস্তির শর্ত পূরণ হলে আগামী জুন মাসে মোট ঋণের অবশিষ্ট ২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১ দশমিক ৩০ বিলিযন ডলার মিলবে। আর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠকটি ২১ এপ্রিল শুরু হয়ে ২৬ এপ্রিল শেষ হয়। বসন্তকালীন বৈঠকের এক ফাঁকে আইএমএফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের পার্শ্ব বৈঠক হয়। বিষয়টি তখন সুরাহা হয়নি। যার সূত্র ধরে গত ১২ মে একমত হয় দুই পক্ষ। আর ঋণ আসবে ২৯ জুন। যদিও ঋণের শর্ত পর্যালোচনা করতে আসা আইএমএফের প্রতিনিধি দল ১২ দিনের সফর সমঝোতা ছাড়াই ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করে ওইদিন ঢাকা ত্যাগ করে। আর ২০২৩ সালে আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে।
আরেক অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সময়ের আলোকে বলেন, আগের সরকারের আমলে ডলারের রেট অনেক দিন ধরে রাখায় অতীতে সমস্যা হয়েছিল। কোনো একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতেই এটি করা হতো। এখন উন্মুক্ত করায় কেউ বিশেষ সুবিধা পাবে না। যখন অবমূল্যায়ন হওয়ার কথা, তখন হবে। আমি মনে করি এর ফলে বিভিন্ন দিক থেকে সুবিধা আসবে। রফতানি বাড়বে, বিনিয়োগ বাড়বে, রিজার্ভ বাড়বে। সর্বোপরি বলব কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অর্থনীতির জন্য ভালো হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : mainadmin
কমেন্ট বক্স